ঢাকা বৃহস্পতিবার
০২ মে ২০২৪
২৪ এপ্রিল ২০২৪

আনন্দের ১১০ বছরের আনন্দ


নিউজ ডেস্ক
177

প্রকাশিত: ২০ জুন ২০২১
আনন্দের ১১০ বছরের আনন্দ



সিদ্দিকুর রহমান আনন্দ কনফেকশনারির তৃতীয় প্রজন্ম। তাঁর দাদা শেখ চান মিয়া ১৯ শতকে ঢাকায় এসেছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারী থেকে। দেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছিল। সে সময় ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল নর্থব্রুক হল, সাধারণের ভাষায় লালকুঠি। সেখানে মঞ্চনাটক হতো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেগুলো ঘিরে শিল্পী–সাহিত্যিকেরা আসতেন, আড্ডা জমত, খাওয়াদাওয়া হতো। সব মিলিয়ে জমজমাট এলাকা। লালকুঠির পাশে এক খাস ইংরেজের বেকারির দোকান, সেখানে কাজ নেন ফরিদপুরের চান মিয়া। অখণ্ড বাংলার রাজনীতিতে তখন পালাবদলের সময়। বঙ্গভঙ্গ হয়েছে। ফলে ঢাকার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। কয়েক বছরের মধ্যে আবার বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। এরই মধ্যে এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে বিদায় নেন ব্রিটিশ বেকারির মালিক। তত দিনে অবশ্য চান মিয়া কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন, হাতে অর্থকড়িও জমেছে কিছু। সেই টাকা দিয়ে আবুল হাসনাত রোডে সংগীতশিল্পী লায়লা আঞ্জুমান বানুর বাবার বাগানবাড়ি কিনে সংসার পেতেছেন।
যেহেতু জীবনভর বেকারির কাজই শিখেছেন। এখানেই থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন চান মিয়া। বাড়ির একপাশেই একটা বেকারি গড়ে তোলেন। সময়টা ১৯১১ সাল। শুধু বেকারি দিয়ে বসলেই তো হলো না, ক্রেতাও থাকা চাই। রুটি–বিস্কুট খাওয়া অভিজাত লোকেরা চলে গেছেন পূর্ব বাংলা ছেড়ে। তাই টিকে থাকার জন্য চান মিয়াকে নামতে হয় অন্য এক যুদ্ধে। সারা রাত ধরে তিনি রুটি ও বিস্কুট বানিয়ে সকালে সেগুলো নিয়ে চলে যেতেন বিভিন্ন হাটে। সাধারণ মানুষই ছিল তাঁর কেক ও বিস্কুটের ক্রেতা। শুক্র ও শনিবার জিনজিরায় যান তো রোববার ছোটেন টঙ্গী হাটে। এভাবে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতেও তিনি কোনো না কোনো হাটে রুটি–বিস্কুট বিক্রি করতেন। ঢাকায় তখন বেকারি ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। মানুষেরও তখন পর্যন্ত বেকারির তৈরি খাদ্যপণ্য খাওয়ার তেমন অভ্যাস হয়নি। চান মিয়ার নিরন্তর চেষ্টায় ধীরে ধীরে ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে বেকারি পণ্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে একটি স্থায়ী দোকান খোলেন চান মিয়া। এটির নাম দেন আনন্দ কনফেকশনারি।
আনন্দের ১১০ বছরের আনন্দ
আনন্দ নামটি দেওয়ার পেছনেও আছে এক গল্প। চান মিয়া পদ্মাপারের মানুষ। তাই সংগত কারণেই সুরের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। নাতি সিদ্দিকুরের ভাষায়, ‘আমার দাদা একই সঙ্গে খুব ধার্মিক ও সংগীতপ্রেমী ছিলেন। সব সময় গুন গুন করে গজল, হামদ, নাত গাইতেন। বেকারির কাজটাও যেন তাঁর কাছে ইবাদতের মতো ছিল। খুব চেষ্টা করতেন সুন্দর কাজ করার। আনন্দময় জীবনের এসব দর্শন থেকেই কনফেকশনারির নাম রাখেন আনন্দ।’ ’৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে মারা যান চান মিয়া। তাঁর ছেলে তারা মিয়া এ ধাক্কা সামলাতে সামলাতেই চলে আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডবে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় তাঁর পরিবার। যুদ্ধ চলাকালেই ফিরে এসে বেকারি চালুর সিদ্ধান্ত নেন তারা মিয়া (সিদ্দিকুরের বাবা)। দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে তিনি যখন ব্যবসার হাল ধরলেন, তখনো উত্তাল ছিল দেশের রাজনৈতিক অবস্থা। তবে এর মধ্যেও আনন্দ যে খুব খারাপ চলছিল এমন নয়। সিদ্দিকুর বলেন, ‘আমাদের দোকানে বিখ্যাত মানুষেরা আসতেন। আমাদের পণ্যও যেত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। আমরা তখন ছোট। পত্রিকায় যাঁদের ছবি আসত, টিভিতে যাঁদের দেখা যেত, তাঁরা আমাদের দোকানে আসতেন, ভাবতেই খুব ভালো লাগত।’
আনন্দের ১১০ বছরের আনন্দ
সিদ্দিকুরদের এই ভালো লাগা খুব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কারণ, ১৯৭১ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে থাকে। শুরুতে পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডবে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান সিদ্দিকুরের বাবা তারা মিয়া। দেশের বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে থেকে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেন, ফিরে আসবেন ঢাকায়, যুদ্ধের মধ্যেই চালু রাখবেন বেকারি। যুদ্ধের মধ্যে ফিরে এসে তারা মিয়া নিজের বাড়িতে সীমিতভাবে শুরু করেন বেকারির কার্যক্রম। সে সময়ের কথা স্মরণ করে সিদ্দিকুর বলেন, ‘তখনই আমাদের কাজে হাতে খড়ি। আমরা, মা, দাদি—সবাই মিলে বেকারির কাজ করতাম। বাবা বিক্রি করতেন। এভাবে যুদ্ধের মধ্যেও কাজ চালিয়ে গিয়েছিলাম আমরা।’ যুদ্ধ শেষে অর্থাৎ সদ্য স্বাধীন দেশের সঙ্গে আনন্দ বেকারিও নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। তারা মিয়া তাঁর ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ব্যবসার হাল ধরেন। আবুল হাসনাত রোডের পর ১৯৮৭ সালে চকবাজারে খোলেন দ্বিতীয় শাখা। এরপর ’৯০–তে পুরান ঢাকা থেকে বের হয়ে নতুন ঢাকার (মহাখালী) শাহীন কমপ্লেক্সে আরেকটি। সর্বশেষ ২০১২ সালে পুরান ঢাকার ওয়ারীতে চালু করা হয় চতুর্থ শাখাটি। সব মিলিয়ে চারটি শাখা নিয়েই চলছে আনন্দ কনফেকশনারির কার্যক্রম। এ কার্যক্রম শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক।

আরও পড়ুন:

বিষয়: