ঢাকা বৃহস্পতিবার
০২ মে ২০২৪
২৩ এপ্রিল ২০২৪

প্রতারক কোম্পানি চেনার কিছু কৌশল


নিউজ ডেস্ক
38

প্রকাশিত: ৩০ জুলাই ২০১৮
প্রতারক কোম্পানি চেনার  কিছু কৌশল



ইমরান হোসেন:  “প্রতারক” শব্দটি পুঁজিবাজারের সাথেও জড়িত। বিনিয়োগকারীরা ভাল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে দীর্ঘমেয়াদে যেমন লাভবান হতে পারেন। তেমনভাবে প্রতারক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে প্রতারিত হবেন। প্রশ্ন হলো প্রতারক কোম্পানি কিভাবে চেনা যাবে?

প্রতারনার জাল ছড়ানো এই সমাজে প্রতারক মানুষ চেনা যেমন খুব সহজ না, ঠিক তেমনি প্রতারক কোম্পানি চেনা খুব সহজ না। অনেক বিচার বিশ্লেষণ করে বুঝতে হবে কোন কোম্পানি ভাল বা বিনিয়োগকারী বান্ধব। আর কোন কোম্পানি প্রতারক। ভাল মানুষ চিনতে গেলে আমরা যেমন তার অতীত, বর্তমান, আচার আচারণ বিচার বিশ্লেষন করে সিদ্ধান্ত নেই। ঠিক তেমনি কোম্পানির ক্ষেত্রেও কোম্পানি অতীত, বর্তমান আচার আচারণ বিচার বিশ্লেষন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোম্পানি ভাল না প্রতারক।

সাধারন বিনিয়োগকারী কেউ  প্রতারক কোম্পানি চিনতে চাইলে কিছু সহজ উপায় বিচার বিশ্লেষন করতে পারেন। যেমন

কোম্পানির ম্যানেজমেন্টে কারা আছেন? তারা ব্যক্তি হিসেবে কেমন? তারা ব্যক্তি হিসেবে ভাল না হলে, কোম্পানিও আপনাদের কে ঠকাবে। আপনি যাদের সাথে ব্যবসা করবেন তারা খারাপ মানুষ হলে হয় অপনার পুঁজি যাবে আথবা আপনি ব্যবসা করে কিছুেই পাবেন না। এই বিষয়টি সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

  • কোম্পানির লভ্যাংশ নীতিমালা কেমন? ক্যাশ লভ্যাংশ দেয়তো? নাকি শুধুমাত্র স্টক (বোনাস) দিয়ে বিনিয়োগকারীদের কে বোকা বানানোর চেস্টা করছে। কোম্পানির আয়ের কত অংশ (ডিভিডেন্ট পে-আউট রেশিও) লভ্যাংশ আকারে প্রদান করছে? লভ্যাংশ সাময়িকভাবে কম দিলে, সেটা কোন সম্প্রসারণের প্রকল্প কারণে কিনা? প্রকল্প সম্প্রসারণ বা কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি মজবুত করার জন্য লভ্যাংশ কম দিলে বা না দিলেও ঠিক অাছে বরং সেটাই ভাল লক্ষণ বিনিয়োগকারীদের জন্য (ডে ট্রেডারদের জন্য খারাপ হতে পারে)। ক্যাশ লাভংশ দিতে পারাটা ভাল কোম্পানির লক্ষণ। কোম্পানি তার আয়ের ক্ষুদ্র অংশও ক্যাশ দিতে পারছে কিনা?

আমাদের মার্কেটে একটা সময় ছিল যখন সবাই স্টক ডিভিডেন্ড পেতে খুব পছন্দ করত। অবশ্য এখন অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। সাধারন বিনিয়োগকারীগন এখন স্টক ডিভিডেন্ডের চাইতে ক্যাশ ডিভিডেন্ড পেতেই বেশি উৎসাহী। স্টক ডিভিডেন্ড মানে কোম্পানি আপনাকে মুনাফার টাকা না দিয়ে তা আবার তার নিজ ব্যবসায় বিনিয়োগ করবে এবং আপনাকে ঐ ব্যবসার আরও কিছুটা মালিকানা দেবে।

এখন ঐ ব্যবসা যদি সামনের দিন গুলোতে কম মুনাফা করে (বাস্তবে আমাদের দেশের অধিকাংশ কোম্পানির ব্যবসা বাড়ে না, শুধু মূলধন বাড়ে বা শেয়ার সংখ্যা বাড়ে), তবে কম্পানির শেয়ার দর কমে যাবে এবং আপনি যে অতিরিক্ত স্টকগুল ডিভিডেন্ড হিসেবে পেলেন তার মূল্য কমে যাবে।

ফলে ক্যাশের চাইতে স্টক ডিভিডেন্ড নেয়ায় আসলে আপনি ক্ষতিগ্রস্থ হলেন। তবে ভাল কোম্পানির ক্ষেত্রে স্টক ডিভিডেন্ডও ভাল। যে কোম্পানি মূলধন বাড়ার সাথে সাথে ব্যবসাও বাড়াতে সক্ষম এমন কোম্পানির স্টক ডিভিডেন্ড।

কিন্তু আমাদের দেশের অনেক কোম্পানি স্টক ডিভিডেন্ট দেওয়াটাকে একটি প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যাবহার করছে। স্টক ডিভিডেন্ট  দিয়ে অনেক পরিচালক মার্কেট প্রাইজে (উচ্চ মূল্যে) ডিএসইতে বিনা নোটিশে সাধারণ মার্কেটে সেগুলো বিক্রি করে দিচ্ছে। এই লাভের লোভে তারা কোম্পানির উৎপাদন ও বিপণনের কাজ বাদ দিয়ে প্রতি বছর বোনাস বা স্টক উৎপাদনে ব্যস্ত। যে কারনে খেয়াল করলে দেখবেন বোনাস লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানির আয় কমতির দিকে।

উদাহরণ,  ২০০৯ থেকে ২০১১ পর্যন্ত অনেক ব্যাংকই ১০০%, ৭৫%, ৫০% এই রকম উচ্চ হারে স্টক ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। পরবর্তীতে উচ্চ স্টক ডিভিডেন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যাবসা করতে না পারায় ইপিএস যায় কমে, ফলে ব্যাংকের স্টক এখন কম টাকায় লেনদেন হচ্ছে।

কেন এমন হল? ধরুন ১০,০০০ শেয়ার আছে এমন একটি কোম্পানির বাৎসরিক মুনাফা হল ১,২০,০০০ টাকা। মানে ইপিএস ১২ টাকা। এবার কোম্পানি ঐ ১২ টাকা আপনাকে ক্যাশ না দিয়ে ফেস ভ্যালু ১০ টাকা হিসেবে ১০০% স্টক ডিভিডেন্ড দিল। অর্থাৎ কোম্পানি ১২ টাকার স্থলে আপনাকে দিল ১০ টাকার মালিকানা এবং ঐ ১২ টাকা ব্যাবসায় বিনিয়োগ করল। পরের বছর কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা হল ২০,০০০। ঐ বছর ইপিএস ১২ টাকা ঠিক রাখতে হলে কোম্পানিটিকে মুনাফা কতে হবে ২,৪০,০০০ টাকা মানে মুনাফা ১০০% বাড়াতে হবে।

এ বছর ১০০% মুনাফা করা সম্ভব না হলে ইপিএস যেমন কমে যাবে তেমনি স্টকের দাম ও কমে যাবে। তাই ২০-৩০% স্টক ডিভিডেন্ড দিলেই উল্লসিত হবার কিছু নেই। স্টকটি আরও ১ বছর ধরে রাখার আগে অথবা যারা স্টক পাবার আশায় কিনবেন তারা চিন্তা করুন কোম্পানিটি কি সামনের ১ বছরে ২০-৩০% (স্টক ডিভিডেন্ডের সম পরিমাণ) মুনাফা বাড়াতে সক্ষম? যদি উত্তর ‘না’ হয় তবে এই স্টকে বিনিয়োগ করার আগে দ্বিতীয় বার ভাবুন।

কোম্পানি প্রচলিত আইনগুলো মেনে চালে কিনা। যে কোম্পানি বার বার আইন ভঙ্গ করে তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন অছে। বিনিয়োগকারীকে ঠকাতে সে দ্বিধা করবে না।

কোম্পানির ট্যাক্স প্রদানের হার শতাংশে বাড়ছে কিনা? যে কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট সরকারকে ট্যাক্স দিতে চায় না ঐ কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট ক্ষুদ্রবিনিয়োগকারীকেও কিছু দিতে চাইবে না। স্বর্ণকার নাকি শোনা যায় নিজের মায়ের গহনা থেকেও স্বর্ণ চুরি করে। তার মানে ঠকান যার অভ্যাস সুযোগ পালে সে যে কাউকে ঠকাবে।

পরিচালকদের শেয়ার হোল্ডিং প্যার্টানটি দেখবেন। যে কোম্পানিতে পরিচালকদের হোল্ডিং কম সে কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করাই ভাল। কারণ কোম্পানিতে পরিচালকরা আস্থা রেখে কোম্পানিতে বিনিয়োগ রাখে নাই। আপনি কিভাবে রাখবেন? অন্যের কোম্পানির প্রতি পরিচালকরা কতটুকুই দরদ দেখাবে? আবার খেয়াল করবেন কোম্পানির পরিচলকরা শেয়ার উপহার দেওয়ার কৌশলে পরিবারের অন্য সদস্যের নামে শেয়ার দিয়ে , ঐ শেয়ার সাধারণ মার্কেট বিক্রি করার চাতুরি করছে কিনা। চাতুরি শব্দটা ব্যবহার করার কারণ পরিচলকরা নিজের নামের শেয়ার বিক্রি করতে হলে ডিএসইতে নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু শেয়ার ট্রান্সফার করে অন্য কারও নামে দিয়ে, সেখান থেকে বিনা নোটিশে বিক্রয় করা যায়।

সম্পদ পুনঃমূল্যায়নের নামে শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে নাতো? সম্পদ পুনঃমূল্যায়ন অস্বাভাবিক নয়তো?

হঠাৎ অস্বাভাবিক লভ্যাংশ দেওয়া কোম্পানির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। হঠাৎ অস্বাভাবিক লভ্যাংশ দিয়ে গ্যাম্বেলিং করতে সাহায্য করছে কিনা ভেবে দেখতে হবে। নাকি আসলেই সৎ উদ্দেশ্যে দিল।

নতুন প্রকল্পের নামে শেয়ার নিয়ে গ্যাম্বেলিং করতে সাহায্য করছে কিনা ভেবে দেখতে হবে। কোন প্রকল্প করলেই লাভ ডবল হয় না , যে শেয়ারের দাম সাথে সাথে ডবল হতে হবে। সাধারণতো স্বল্প সময়ে গ্যাম্বেলিংয়ের কারণে প্রাইজ ডবল হয়। আর ফান্ডামেন্টাল বা ফাইন্যানসিয়াল কারণে প্রাইজ ডবল হতে সময় লাগে।

যে কোম্পানির পরিচালকরা নিজেদের শেয়ার ধারাবাহিকভাবে বিক্রয় করছে, সে কোম্পানিতে বিনিয়োগ না করাই ভাল। বুঝতে চেস্টা করা উচিৎ কেন পরিচালক শেয়ার বিক্রয় করছে। কোম্পানির অবস্থা খারাপ তাই নাকি অন্য কারণ।

কোম্পানির কোনো তথ্য জানতে চেয়ে (আইনগত ভাবে যে তথ্য আপনি পেতে পারেন) যদি তাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান অর্থ কর্মকর্তা বা কোম্পানি সচিবের সাথে কথা বলতে চান, রিসিপশনের নানা অজুহাতে আপনাকে আটকাবে বা তথ্য দিবে না, মানে কোম্পানি আপনার সাথে সম্মানজনক আচরণ করবে না।

ব্যাক টেস্ট করুন মানে বিগত কয়েক বছরের আর্থিক প্রতিবেদন ঘাটুন। দেখন ব্যাবসা কেমন? প্রবৃদ্ধি কোন দিকে ইতিবাচক না নেতিবাচক। প্রবৃদ্ধি যে কোন দিকে গেলে তার যৌক্তিক কারণ আছে কিনা। ঐ সেক্টরের অন্যান্য কোম্পানির অবস্থা সেম কিনা যাচাই করুন।

এজিএমে যে সব কোম্পানি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকে বক্তব্য রাখতে সুযোগ দেয় না বরং এক শ্রেণির দালাল কে(এজিএম পার্টির সদস্যদেরকে) ভাড়া করে খুব দ্রুত সময়ে এজেন্ড পাশ করে এজিএম শেষ করে এবং  তেমন কোন কোম্পানির বার্ষিক প্রতিবেদন বা ব্যবসা নিয়ে আলোচনা করে না। এজিএমে এক শ্রেণির দালাল (এজিএম পার্টি) চক্রের দৌরত্ম বা প্রভাব থাকে। অবশ্য অাজকাল এজিএম পার্টি অধিকাংশ কোম্পানির এজিএমে যায় তবে ভাল কোম্পানির এজিএমে তারা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না।

হঠাৎ আর্নিং পার শেয়ার (ইপিএস) বা লভ্যাংশ অস্বাভাবিক বাড়বে অথবা কমবে তেমন কোন কারন ছাড়াই বা এক্সা-অর্ডিনারী ইনকাম বা ব্যবসা বৃদ্ধি বা সেলস (পণ্য বিক্রয়) ছাড়াই।

বার্ষিক প্রতিবেদনে বড় বড় আশার কথা বলবে কিন্তু বাস্তবে সেগুলো বাস্তবায়ন হয় না । আগেও এমন আশার কথা শুনিয়েছিল। খোঁজ-খবর নিলে জানা যাবে।

দেখুন কোম্পানির সেল বাড়ার সাথে সাথে সরকারকে ট্যাক্স দেওয়ার পরিমান বাড়ছে কিনা? যে কোম্পানি সরকারকে ট্যাক্স দিতে চায় না সাধারণত তারা বিনিয়োকারীকে লভ্যাংশ দেয় না। কোম্পানির অায় নিজেরাই ভোগ করবে অপারেটিং কস্টসহ নানা কস্ট দেখিয়ে।

প্রতারক কোম্পানির মালিক বা ম্যানেজমেন্ট শ্রমিকদেরকে ঠকায় বা  শ্রমিকদেরকে সঠিক পাওনা ও সুযোগ সুবিধা দেয় না। কোন কোম্পানিতে বিনিয়োগ করার অাগে ঐ কোম্পানিতে কাজ করে এমন কয়েকজন শ্রমিকের সাথে কথা বললে কোম্পানির মালিক কেমন মানুষ বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। মানে কোম্পানির সব লাভ নিজের পকেটে নিবে না অন্যান্যদেরকে ও কিছুটা দিবে সেটা বুঝা যাবে।

উক্ত বিষয়গুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে প্রতারক না ভাল কোম্পানি সেটা অনেকটাই বুঝা যাবে। তবে যে কোন একটি আলামত দেখে সিদ্ধান্তে আশা ঠিক হবে না বরং সার্বিক বিচার-বিশ্লেষণ  করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ইমেইল imranhoshen71@gmail.com অারও পড়ুন ডিভিডেন্ড কি? কখন কিনলে পাওয়া যায়?

আরও পড়ুন:

বিষয়: