ঢাকা শনিবার
২৭ এপ্রিল ২০২৪
১২ সেপ্টেম্বর ২০২১

চীনকে সরিয়ে খেলনার বাজার স্থানীয় উৎপাদনকারীদের দখলে


নিউজ ডেস্ক
86

প্রকাশিত: ০৭ মার্চ ২০২১
চীনকে সরিয়ে খেলনার বাজার স্থানীয় উৎপাদনকারীদের দখলে



ফেব্রুয়ারির এক সকালে দেখা গেল ঢাকার উপকণ্ঠ কামরাঙ্গীরচর এলাকায় আট নারী একে-৪৭ রাইফেল নিয়ে ব্যস্ত, যে রাইফেলকে বলা হয় ২১ শতকের সবচেয়ে শক্তিশালী এক মারণাস্ত্র।শ্রমিকদের একজন মনি বেগম। তাকে দেখা গেল রাইফেলের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ- পাইপ, স্প্রিং, ম্যাগাজিন লক, ট্রিগার ও গ্যাস টিউব ইত্যাদি নিয়ে পুরোদমে কাজ করতে। বাকিরা ব্যস্ত ছিলেন স্বয়ংক্রিয় একটি স্ক্রুড্রাইভারের মাধ্যমে রাইফেলের ভেতরে ছোট কালো স্ক্রু ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজে।রাইফেলের গায়ে বড় অক্ষরে লেখা সতর্কবার্তা: 'মানুষ অথবা প্রাণীর দিকে গুলি ছুঁড়বেন না।' এ পর্যন্ত পড়ে কি ভয় পাচ্ছেন? না, ভয়ের কারণ নেই। কারণ দুই ফুট লম্বা এই রাইফেলগুলো আসলে প্লাস্টিকের তৈরি। তবে এই রাইফেলগুলো কিন্তু পুরোমাত্রায় সুসজ্জিত। বাটস্টক, হিটশিল্ড এবং পিস্তলের গ্রিপ বানানো হয়েছে হলুদ রঙে; আর রাইফেলের মূল বডি ও ম্যাগাজিন কালো রঙের।শিশুদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি খেলনা এই নকল একে-৪৭ রাইফেল।

দেশের সবচেয়ে বড় খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এভারেস্ট টয় ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড প্রতিদিন ২ হাজার পিস একে-৪৭ রাইফেল উৎপাদন করে। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি অন্যান্য রাইফেল, অ্যাম্বুলেন্স, রেসির কার, বাস ও মোবাইল ফোনের রেপ্লিকা খেলনাও তৈরি করে।এভারেস্ট টয় ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শাহজাহান মজুমদার জানালেন, তাদের মোট খেলনা উৎপাদনের ৬০ শতাংশই রাইফেল বা বন্দুক। প্রতিষ্ঠানটির দুটি ফ্যাক্টরি রয়েছে, যেখানে ৪০০ শ্রমিক কাজ করেন। তারা প্রায় ২০০ প্রকারের খেলনা উৎপাদন করে থাকেন।শাহজাহান মজুমদার বাংলাদেশের খেলনা শিল্পের মূল সংগঠন 'বাংলাদেশ টয় মার্চেন্টস ম্যানুফ্যাকচারারস অ্যান্ড ইমপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশনে'রও সভাপতি।

শাহজাহান বলেন, 'বিভিন্ন কোম্পানি বিভিন্ন পণ্যকে গুরুত্ব দেয়, আমরা বন্দুক বেছে নিয়েছি। আগে যখন একে-৪৭ খেলনা রাইফেল চীন থেকে আমদানি করা হতো, দাম পড়তো ২০০ টাকা। আমাদের পাইকারি দামে এটি ৮০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।'বাংলাদেশে খেলনা শিল্পে এভারেস্টই একমাত্র কোম্পানি নয়। দশ বছর আগে যেখানে খেলনা শিল্প পুরোপুরি আমদানিনির্ভর ছিল, সেখানে বর্তমানে ছোটবড় ১৫০টি ফ্যাক্টরি এখন খেলনা উৎপাদন করছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিরা মনে করেন, খেলনা শিল্পের সার্বিক বাজার অন্তত ৬ হাজার কোটি টাকার। দেশীয় খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যেই মোট মার্কেট শেয়ারের ৮০ শতাংশ কব্জা করে ফেলেছে।

চকবাজারে নিজের পাইকারি খেলনা দোকানের ডেস্কে বসে শাহজাহান জানালেন এই শিল্পের দিন বদলের কথা, 'আগে যা বিদেশ থেকে আনতে হতো, তা এখন আমরাই বানাচ্ছি। এগুলো সবই চীনা খেলনার নকল। দুই দশক আগেও এসব আমাদের কাছে অজানা ছিল।'শাহজাহান এই প্রতিনিধিকে জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে দেশীয় পর্যায়ে ১৫০০ ধরনেরও বেশি খেলনা বানানো হচ্ছে।কামরাঙ্গীরচরের কারখানায় দেখা গেল, নজরুল ইসলাম নামে এক শ্রমিক ইনজেকশন মোল্ডিং মেশিনের ভেতর থেকে খেলনা অ্যাম্বুলেন্সের নিচের অংশের ছাঁচ টেনে বের করছেন। নাজমুল গত তিন বছর ধরে এই ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'মেশিনে অ্যাম্বুলেন্সের লোয়ার পার্ট বানাতে ৩০ সেকেন্ড লাগে। এক ঘণ্টায় আমরা ১১০ পিস লোয়ার পার্টের ছাঁচ গড়তে পারি।'

একটি খেলনা বানাতে এর বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা ছাঁচে দিয়ে বানাতে হয়। কামরাঙ্গীরচরের এই কারখানায় খেলনার বিভিন্ন অংশের জন্য আলাদা আলাদা মোট ১২টি বড় প্লাস্টিক ইনজেকশন মোল্ডিং মেশিন রয়েছে। যেমন, একটি রেসিং কার বানাতে হলে কারখানার কর্মীদের একটি ছাঁচে গাড়ির চাকা, অন্যটিতে উইন্ডশিল্ড, আবার অন্য একটিতে গাড়ির বডি বানাতে হবে।

কীভাবে এই ব্যবসায়ে এলেন শাহজাহান?

শিশুরা খেলনা হাতে পেলেই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়, সে কথা কে না জানে? ছোটবেলায় শাহজাহান নিজে কাগজ, মাটি, আরও কত কি দিয়েই না খেলনা বানানোর চেষ্টা করেছেন! নিজের চেয়ারে হেলান দিতে দিতে তিনি সে কথাই জানালেন, 'জানি না কেন, কিন্তু খেলনার প্রতি একটা আকর্ষণ আমার সবসময়ই ছিল।'১৯৭৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পাস করার পর ব্যবসায়ী হবার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকায় পা বাড়ান শাহজাহান।পুরান ঢাকার শোয়ারি ঘাট এলাকায় একটি টেনিস বল ফ্যাক্টরিতে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন তিনি। এই ফ্যাক্টরিতে রবার বল ও জুতা তৈরি হতো।

শাহজাহান জানালেন, তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ব্যবসায়ের খুঁটিনাটি শেখা। তিন মাসের মধ্যেই তিনি ফ্যাক্টরির সকল ধরনের কাজ শিখে ফেলেন। শাহজাহানের ভাষ্যে, 'আমি ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে একজন হেল্পার কী কাজ করতেন, তাও শিখেছি; একজন কারিগর কী করতেন, সেটিও শিখেছি। এরপর আমি মেশিন চালানো শিখে ফেলি।'পরের বছর, ১৯৭৮ সালে শাহজাহান নিজেই একটি রবার বল ফ্যাক্টরি দেওয়ার মনস্থির করেন। কিন্তু তার কাছে কোনো পুঁজি ছিল না। নিজের গ্রামে ফিরে গিয়ে বাবার অজ্ঞাতে চার একর জমি বিক্রি করে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ফিরে আসেন তিনি।

অবশ্য সেবার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল না শাহজাহানের। লোকসানের শিকার হয়ে তিনি ১৯৮৮ সালে ব্যবসা বিক্রি করে দেন। একই বছরে তিনি প্লাস্টিক খাতে বিনিয়োগ করার জন্য ফ্যাক্টরি গড়ে তোলেন।এবার শাহজাহান প্লাস্টিক দিয়ে ক্রিকেট বল তৈরি করতে শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্লাস্টিক বলের জনপ্রিয়তা বেশ বেড়ে যায়, ফলে তার ব্যবসারও উন্নতি হতে থাকে। এর পাশাপাশি শাহজাহান ২০০১ সালে চীন থেকে খেলনা আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেন।

শাহজাহান বলেন, 'আমি ২০০১ সালে প্রথম চীনে যাই। আমি ভাবতেও পারিনি চীন এত সুন্দর। কাউকে জানাইনি, তখন চীনে যাচ্ছি। যেহেতু রাজনীতি করি, তাই ভেবেছিলাম লোকে হয়তো খারাপভাবে নিতে পারে।'২০০৮ সালে বাংলাদেশের খেলনা শিল্পের বাজারমূল্য ৫ কোটিতে দাঁড়ায়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা আরেকটু ভালোমানের চীনা খেলনার দিকে আগ্রহী হয়ে পড়েন। ২০১০ সাল থেকে খেলনা শিল্পের দেশীয় বাজার বিকশিত হতে থাকে এবং চীনা খেলনা আমদানি কমতে থাকে।শাহজাহান মনে করেন, দেশীয় বাজারের এই বিকাশের কারণ আমাদের সস্তা শ্রমমূল্য।

কী প্রত্যাশা এই শিল্পে?

বিগত এক দশকে দেশীয় খেলনা শিল্পের বাজারে ব্যাপক উন্নতি দেখা গেছে। শাহজাহানের মতে, এই শিল্প এখনো বর্ধনশীল; কারণ স্থানীয় শিল্পক্ষেত্র এখন কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল। প্লাস্টিক, সার্কিট বোর্ড, এলইডি লাইট, স্ক্রু স্প্রিং, ছোট স্পিকারসহ নানা যন্ত্রাংশ তাদের আমদানি করতে হয়। তবে শাহজাহান এও জানাতে ভোলেননি, এই শিল্পের সম্ভাবনা কত বিশাল। সারা বছরই দেশে খেলনাগুলো বিক্রি হয়। সেইসঙ্গে এখন বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে।

বর্তমানে খেলনা শিল্পে সরাসরি সম্পৃক্ত আছেন ৫০ হাজার ব্যক্তি। তবু শাহজাহান মনে করেন, সরকার এই শিল্পকে যথাযথ গুরত্ব দিয়ে দেখছে না। খেলনা উৎপাদন শিল্প একটা লম্বা সময় ধরে আলাদা একটি ক্ষেত্র হিসেবে চাহিদা বজায় রেখেছে। কিন্তু সরকার এই চাহিদা পূরণ করেনি।

শাহজাহান বলেন, 'খেলনা শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বস্তু। আপনি কোনো বাচ্চাকে একটা খেলনা গাড়ি দিলে সে এটা ভেঙে দেখতে চায় ভেতরে কী আছে, কেন গাড়িটা চলছে। এগুলো তাদের জন্য শিক্ষণীয়। বাচ্চারা এখান থেকেই আনন্দ পায়।'


আরও পড়ুন: