ঢাকা বৃহস্পতিবার
০২ মে ২০২৪
২৩ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ


নিউজ ডেস্ক
111

প্রকাশিত: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১
বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, প্রস্তুতিতে বাংলাদেশ



বৈশ্বিক বাজারে বেড়ে চলেছে ভোগ্যপণ্যের দাম। বছরজুড়েই তেল এবং অন্যান্য পণ্যের বাজারে অস্থিরতা বজায় থাকবে। একই সাথে বিশ্বব্যাপী বাড়ছে ক্রেতাদের উদ্বিগ্নতা।বৈশ্বিক বাজারে মূল্য বৃদ্ধির আঁচ বাংলাদেশি ক্রেতারাও টের পাওয়া শুরু করেছেন। ফলে আমদানিকারকরাও অধিক মাত্রায় আমদানি ও মজুদে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। সরকারও কাঁচাবাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে।

দ্য ইকোনমিস্ট গ্রুপের গবেষণা ও বিশ্লেষণকারী বিভাগ দ্য ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এক দশকের মধ্যে ২০২১ সালে শস্যদানা, তেলবীজ ও চিনিসহ বিভিন্ন খাদ্যমূল্যের দাম সবথেকে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাবে।২০২১ সালের পুরো বছরজুড়েই মূল্যবৃদ্ধি বজায় থাকবে। ২০২২ সালের আগে তা স্বাভাবিক হবে না। ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণের পর বিশেষজ্ঞ দল এই মত দিয়েছে।

গত বছর ১৬ ডলার করে থাকলেও, এবার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ব্যারেল প্রতি ৬০ ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। আগামী বছর জ্বালানি তেলের মূল্য কমলেও, তেলবীজের মূল্য আরও দুই বছর ঊর্ধ্বগামী থাকবে। গ্লোবাল বিজনেস ইনটেলিজেন্সে দ্য বিজনেস লিডারের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।চীনের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রত্যাবর্তনের কারণেই ২০২০ সালের শেষ থেকে ২০২১ সালে শুরুতে এসে বেড়ে চলেছে ভোগ্যপণ্যের দাম।চীনে উৎপাদন, নির্মাণকাজ ও অন্যান্য শিল্প-কারখানার কার্যক্রমের জন্য স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম এবং কপারের চাহিদা বেড়েছে। সেই সাথে বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা।

এছাড়া, বিশ্বে ভ্যাকসিন নিয়ে উদ্দীপনা এবং ২০২১ সালে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আশাবাদ ছড়ানোয় কারখানার মালামাল থেকে শুরু করে প্রধান খাদ্যশস্য, খনিজ তেল সবকিছুর দামে প্রভাব পড়েছে।তবে, খাদ্য, পশুখাদ্য এবং বেভারেজের মূল্য ২০১৯ সালের ক্ষতি ২০২০ সালে এসে সামলে নিতে পেরেছে। করোনা মহামারির মাঝেও খাদ্যের চাহিদা স্থিতিস্থাপক পর্যায়ে ছিল।"আমাদের ধারণা অনুযায়ী ২০২১ সালে খাদ্য, পশুখাদ্য এবং বেভারেজের মূল্য বিগত দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও ২০২২ সালে মূল্য বৃদ্ধি পেলেও তা পরিমিত পর্যায়ে থাকবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে," বলা হয় দ্য ইকোনমিক ইনটেলিজেন্স ইউনিটের পক্ষ থেকে। তবে ২০২১ সালে সামগ্রিক চাহিদা কমে আসবে বলেও আশা করছেন তারা।

"আমরা আশা করছি, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় সামনের মাসগুলোতে অধিকাংশ পণ্যের দাম কমবে। তবে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য সামগ্রিক মূল্যতালিকা বেশ ইতিবাচকচ, বিশেষ করে কপারের মতো ধাতুর জন্য।"২০২০ সালের জানুয়ারির পর অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি প্রথম বারের মতো ৬০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। বৃহস্পতিবার টেক্সাসের খারাপ আবহাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় তেলের দাম হঠাৎ করেই ৬৫ ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে।

ইকোনমিস্ট গ্রুপের গবেষণা ও বিশ্লেষণ বিভাগ ২০২১ সালে তেল বাজারের অস্থিরতা সামান্য কমার ইঙ্গিতও দিয়েছে।বাংলাদেশে রোজার সময় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া বেশ স্বাভাবিক ঘটনা। বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে এ বছর আগে থেকেই বাজারের উত্তাপ পাওয়া যাচ্ছে।চাল এবং ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের মূল্য গত দুই মাস ধরেই বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে, চিনি, ছোলা, ডাল, খেসারি ইত্যাদি যেসব পণ্যের চাহিদা সাধারণত রোজার সময় বাড়ে, তাদের মূল্য ইতোমধ্যেই বেড়ে গেছে।রোজার এখনো মাসখানেক দেরি থাকলেও আমদানিকারকেরা বিশ্ব বাজারে মূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে তড়িঘড়ি করে তাদের মজুদ বাড়াচ্ছে।নগর বন্দরী চট্টগ্রাম ভিত্তিক পণ্য আমদানিকারক মোহাম্মদ আলমগীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বৈশ্বিক বাজারে দামের প্রভাব স্থানীয় বাজারেও পড়ছে।

সরকারি উদ্যোগ

ভোক্তাদের উপর দ্রব্যমূল্যের প্রভাব হ্রাসে সরকার ইতোমধ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ন্যাশনাল প্রাইজ মনিটরিং অ্যান্ড ডিটারমিনেশন কমিটির উদ্যোগে ১৭ টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের স্থানীয় পর্যায়ে মূল্য নির্ধারণের কাজ শুরু হয়েছে।এসব পণ্যের মধ্যে আছে সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুল, আদা, ডাল, ছোলা, লবণ ইত্যাদি।এসেনশিয়াল প্রোডাক্টস মার্কেটিং অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটর রিক্রুটমেন্ট অর্ডার, ২০১১ অনুসারে জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছিল।মূল্য নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত এই কমিটি প্রতি মাসে স্বশরীরে বিতরণকারীদের কার্যক্রম পরিদর্শন করবে এবং প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্যের উঠানামা পর্যবেক্ষণে রাখবে।এছাড়াও, কমিটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, আমদানি ও খুচরা বাজার মনিটরের দায়িত্ব পালন করবে। পণ্যের সাপ্লাই চেইনে কোনো সমস্যা দেখে দিলে সে সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করা হবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের আমদানির উপর সহনশীল পর্যায়ে ভ্যাট আরোপের নির্দেশ দিয়েছে।আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের স্থিতিশীলতা না থাকায়, জাতীয় কমিটি পরিশোধন মিল ও জনসাধারণের স্বার্থে প্রতি মাসে সাক্ষাতের মাধ্যমে মূল্য নির্ধারণ করবে।কনজিউমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও চিনির মূল্য বৃদ্ধি পেলে স্থানীয় বাজারেও স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়বে।"তবে, সরকার চাইলে আমদানি কর কমিয়ে ক্রেতাদের ভোগান্তি কমাতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এছাড়াও কেউ যাতে বিশ্ববাজারের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় ভাবে বাড়তি লাভ করতে না পারে সেজন্য সরকারকে সাপ্লাই চেইনের উপর নজর রাখার পরামর্শ দেন তিনি।ট্যারিফ কমিশনের পরিচালক মুনশী শাহাবুদ্দীন আহমেদ বলেন, "এসেনশিয়াল প্রোডাক্টস মার্কেটিং অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটর রিক্রুটমেন্ট অর্ডার, ২০১১ অনুসারে দেশব্যাপী বিতরণকারীদের নিয়োগ দিতে সকল জেলা কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে।"

আইনানুসারে, জেলা প্রশাসক একজন চেয়ারম্যানের সাথে জেলা কমিটি গঠন করবেন। জেলা কমিটি প্রতিটি জেলার মজুদ এবং সরবরাহ সংক্রান্ত সকল তথ্য নিয়মিত ভাবে সংগ্রহ করে জাতীয় কমিটির কাছে পাঠাবে।বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানী ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান বলেন, "বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা ট্রেডারদের সাথে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ করছি। সাপ্লাই চেইন স্বাভাবিক রাখাসহ বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।"

এছাড়া, টিসিবির মাধ্যমে দ্বিগুণ পরিমাণ পণ্য বিক্রি করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্সের তথ্যানুসারে মহামারির কারণে কারখানা বন্ধ এবং ভোক্তাদের চাহিদা কমে যাওয়ায় ২০২০ সালে শিল্পকারখানার কাঁচামালের জন্য শুরুটা নেতিবাচকভাবেই হয়েছিল।অন্যদিকে, ২০২০ সালের দ্বিতীয় ভাগে চীনে চাহিদা বাড়তে থাকায় কপার, অ্যালুমিনিয়াম, জিংক এবং টিনের দামও বাড়তে থাকে।

দেশের শীর্ষ ঢেউটিন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান পিএইচপি ফ্যামিলির ভাইস-চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোহসিন বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে জিংক, ঢেউটিন এবং অ্যালুমিনিয়ামের মূল্য স্থানীয় বাজারে রাতারাতি কোনো প্রভাব ফেলবে না। আর তাই এখন দাম বাড়ানো আমাদের জন্যও অনুচিত হবে।"অন্যদিকে, টেক্সাসের আবহাওয়ার কারণে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেও বাংলাদেশে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রভাব পড়বে না বলেও জানান কর্মকর্তারা।বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক সৈয়দ মেহদি হাসান বলেন, "আমাদের আমদানি খরচ বাড়লেও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে দীর্ঘস্থায়ী চুক্তি থাকায় সরবরাহে কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না।"


আরও পড়ুন:

বিষয়: