ঢাকা রবিবার
০৫ মে ২০২৪
২৭ এপ্রিল ২০২৪

পর্যটন বদলে দিয়েছে শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতি


নিউজ ডেস্ক
170

প্রকাশিত: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১
পর্যটন বদলে দিয়েছে শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতি



রেল যোগাযোগ ভালো থাকায় অতীতে শ্রীমঙ্গল উপজেলা ছিল মৌলভীবাজার জেলার অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা। জেলা সদরের ব্যবসায়ীরা মালামাল ক্রয় করতেন শ্রীমঙ্গলের পাইকারি বাজার থেকে। ফলে ব্যবসার জন্য জমজমাট এলাকা ছিল এটি।

কিন্তু আশির দশক থেকে অন্যসব এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই জৌলুস হারায় শ্রীমঙ্গল। বর্তমান শতাব্দীতে এই চিত্র বদলে গেছে পুরোপুরি। এখন শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতি পুরোটাই  পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল।

গত ২০ বছরের পরিক্রমায় ট্যুরিজম এখন শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। স্থানীয় প্রশাসনের সর্বশেষ জরিপ বলছে, প্রতিদিন ৫ হাজার পর্যটক আসেন শ্রীমঙ্গলে।

এক সময়  চা বাগানের পাশাপাশি আনারস, লেবুসহ কৃষির প্রতি আকৃষ্ট থাকলেও বর্তমানে অনেকে নিজেদের লেবু বাগান, আনারস বাগানের ব্যবসা বদল করে আসছেন ট্যুরিজম ব্যবসায়। দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে ট্যুরিজম ব্যবসা। ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এসব মানুষের ওপর নির্ভরশীল তাদের পরিবারের লাখো সদস্য।

শ্রীমঙ্গল ঘুরে বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপ করে এর সত্যতা উঠে এসেছে।

উপজেলার রাধনগর গ্রামের শামছুল হক একসময় মুদি দোকানের পাশাপাশি লেবু বাগান গড়ে তোলেন। কিন্তু দিনে দিনে শ্রীমঙ্গল পর্যটন সমৃদ্ধ হওয়ায় তিনি বুঝতে পারেন, এই খাতে ব্যবসা হতে পারে লাভজনক। তাই পরীক্ষামূলকভাবে ২০০৭ সালে লেবু বাগানের ভেতরে এক রুমের একটি ইকো কটেজ করেন। ভাবনার চেয়েও বেশি সাড়া পাওয়ায় পরে তিনটি কটেজ গড়ে তোলেন শামছুল। ২০১৮ সালে এই কটেজের সামান্য দূরে ৩৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আরেকজনের সঙ্গে মিলে নির্মাণ করেন আরও ৫টি কটেজ।

সব মিলিয়ে অর্থনৈতিকভাবে এখন সফল তিনি। পাশাপাশি তার এখানে সরাসরি এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ৩০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। গাড়িচালক, ট্যুর গাইডসহ অন্তত ২০০ মানুষের জীবিকার উৎস এখন এই কটেজগুলো।

শামছুল হকের মতো বিনোয়গ করতে না পারলেও পর্যটন বদলে দিয়েছে রাসেল আলমের জীবন। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি হাউস টিউটর হিসেবে পথচলা শুরু করেন। এরইমধ্যে ২০০৫ সালে আকৃষ্ট হন ইকো ট্যুরিজমের প্রতি। ট্রেনিং নিয়ে ট্যুর গাইড হিসেবে নতুন জীবন শুরু করেন রাসেল। কিছুদিনের মধ্যেই তার আয় বাড়ে কয়েক গুণে।

বর্তমানে (পিক টাইমে) মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় করছেন রাসেল। তিনি জানান, তার আশেপাশে এমন অন্তত ১৫ জন গাইড রয়েছেন- যাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দিয়েছে ট্যুরিজম।

অন্যান্য ব্যবসাও গড়ে উঠেছে পর্যটকদের ঘিরে। চায়ের জন্য বিখ্যাত শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে এলে পর্যটকরা ফেরার পথে চা পাতা কিনে নিয়ে যান।

আগে থেকে বেশ কিছু চা পাতার দোকান থাকলেও গত ২ বছরে তা বেড়েছে কয়েক গুণ। স্টেশন রোড, ভানুগাছ রোডসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় রয়েছে সারিসারি চা পাতার দোকান। একটি উপজেলা শহরে এতগুলো চা পাতার দোকান মূলত পর্যটকদের জন্যই। এত চা পাতার দোকান হলেও বিক্রি হচ্ছে সমান তালে।

ফাহিম এন্টারপ্রাইজের পরিচালক সাইফুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গলে বৈধ ও অবৈধ মিলে অন্তত ২০০ চা পাতার দোকান রয়েছে। পর্যটকরাই এইসব দোকানের মূল ক্রেতা। ২০০ দোকানের ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কয়েক হাজার উপকারভোগী রয়েছেন। এক সময় যারা ছোট ছোট বিভিন্ন ব্যবসা করতেন, তারাও এখন চা পাতার ব্যবসার দিকে আগ্রহী হচ্ছেন।

এর বাইরে সব ধরনের ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন পর্যটকদের মাধ্যমে।

শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এ এস এম ইয়াহিয়া বলেন, 'আমাদের সমিতিতে নিবন্ধনকৃত ২ হাজারের বেশি ব্যবসায়ী রয়েছেন। এদের সবাই কোন না কোনভাবে পর্যটন থেকে লাভবান হচ্ছেন। ক্রেতাদের সার্কেল বা স্থানীয় অর্থনীতির চাকা যেভাবে ঘুরছে, তার চালিকাশক্তি পর্যটকরা। একজন পর্যটক যখন কোনো রিকশা চালককে ৫০ টাকা দেন, সেই চালক সেখান থেকে ১০ টাকা খরচ করেন পাড়ার চায়ের দোকানে। সে হিসেবে এই অর্থনীতির অংশ উপজেলার প্রতিটি মানুষ।'

নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী খাসি কমিউনিটির নেতা সাজু মারছিয়াং জানান, এক সময় তার আয়ের উৎস ছিল পান চাষ। বর্তমানে তার দুটি জিপ রয়েছে, যেগুলো পর্যটক বহন করে। তার মতো তাদের কমিউনিটির অনেকেই পর্যটন ব্যবসার প্রতি আগ্রহ পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

সাজু আরও জানান, কয়েক'শ জিপ গাড়ি রয়েছে শ্রীমঙ্গলে। এসব জিপ এক সময় লেবু, আনারস-সহ কাঁচামাল পরিহনে ব্যবহৃত হতো। দিনশেষে তাদের আয় হতো ৫০০-৬০০ টাকা। তবে বর্তমানে এইসব জিপের বড় একটি অংশ পর্যটক নিয়ে ঘুরে। ফলে বেড়েছে আয়। বর্তমানে তারা দিনে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা আয় করতে পারেন। এছাড়া কার-সিএনজি আটোরিকশাও এখন পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল। কর্মসংস্থান হয়েছে শত শত চালকের।

'চায়ের দেশ' নামে খ্যাত শ্রীমঙ্গল শহরে এখন পা বাড়ালেই দেখা মেলে খাবারের হোটেলের। এইসব হোটেলের বেশির ভাগই নির্ভরশীল পর্যটকদের ওপর।

এর বাইরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তরুণ-তরুণীরাও  পর্যটন থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। বাইরের অতিথিরা শ্রীমঙ্গল আসার আগেই এদের মাধ্যমে হোটেল-রিসোর্ট বুকিং দিচ্ছেন। তাই ডিজিটাল মার্কেটিং করে তারা আয়ের পথ পেয়েছেন।

শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার আহ্বায়ক আবু সিদ্দিক মুসা বলেন, 'শ্রীমঙ্গলে ৭৫টি হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে। তারমধ্যে কোনো-কোনোটির রয়েছেন শতাধিক কর্মচারি। আমাদের রিসোর্টে কর্মচারি রয়েছেন ২৯ জন। আনুমানিক ১ হাজার মানুষ শুধু রিসোর্টেই কাজ করেন।'

'পর্যটকদের কারণে একটি ছোট পানের দোকানদার থেকে সিএনজি চালক- সবাই লাভবান হচ্ছেঞ। আবার যখন এই সিএনজি মেরামত হয়, যদিনি সেটার যন্ত্রংশ ক্রয় করছেন বা গাড়ি মেরামত করছেন- তিনিও লাভবান হচ্ছে। পর্যটনের কারণে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গাড়ি চালকসহ সব মিলিয়ে সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে আনুমানিক ১০ হাজার মানুষের। এদের সবার পরিবার রয়েছে,' বলেন তিনি।

পর্যটনকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে কত টাকা লেনদেন হয়- জানতে চাইলে তিনি বলেন, "একজন পর্যটক ২ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ করেন। বছরে অন্তত ৪ লাখ পর্যটক আসেন। শ্রীমঙ্গলে ৫০০ টাকায় থাকা যায়- এমন হোটেলের পাশাপাশি তারকা হোটেলও রয়েছে। সব মিলিয়ে কয়েক'শ কোটি টাকা এই খাত থেকেই শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।"

শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা একটি জরিপ করেছিলাম, তাতে প্রতিদিন আশেপাশের এলাকা এবং দূরদুরান্ত থেকে ৫ হাজার পর্যটক শ্রীমঙ্গলে ঘুরতে আসার তথ্য পেয়েছি। শ্রীমঙ্গলের অর্থনীতি এইসব পর্যটকের ওপর নির্ভরশীল। যদি কোনো কারণে ৬ মাস পর্যটক এখানে না আসে, তাহলে ৪০ শতাংশ কৃষিপণ্য অবিক্রিত থাকবে। লেবু, আনারস, চাপাতাসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্যের ৪০ শতাংশ সরাসরি ক্রয় করেন পর্যটকরা। পর্যটকদের কারণে সরাসরি প্রায় ১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। যার সুবিধাভোগী তাদের পরিবার ও প্রতিবেশী কয়েক লাখ মানুষ। চা পাতার দোকান, মনিপুরি হস্তশিল্পসহ অনেক ব্যবসা রয়েছে, যার ৯৯ শতাংশ গ্রাহকই পর্যটকরা।'

তিনি আরও বলেন, 'পর্যটনের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়নের পরিকল্পনা করছি আমরা। পর্যটকরা যেন সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনতে পারেন, কোনো মধ্যসত্ত্বভোগী যেন না থাকে- সে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছি। ২০৩০ সালের মধ্যে শ্রীমঙ্গলে পর্যটক বর্তমানের তিন গুণ বৃদ্ধির জন্য আমরা কাজ করছি।'

'আমাদের যে পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন পণ্য সরাসরি পর্যটকদের হাতে যাবে। এতে তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেবে; অন্যদিকে, পর্যটকদের সুবিধার ক্ষেত্রটাও আরেকটু বড় করতে চাইছি আমরা।'


আরও পড়ুন:

বিষয়: