ঢাকা বৃহস্পতিবার
০২ মে ২০২৪
২৩ এপ্রিল ২০২৪

সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত কী বাস্তবায়নযোগ্য?


নিউজ ডেস্ক
41

প্রকাশিত: ২৩ জুন ২০১৮
সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত কী বাস্তবায়নযোগ্য?



স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ ব্যাংকের তফশিলভূক্ত ব্যাংক ৫৭টি। ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বাজেটের আকার, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিচু আয়, আমদানি-রপ্তানির পরিমান অর্থনীতির আকার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছে আর্থিকখাতের পরিসরও। বাড়ছে বিনিয়োগ ও ভোগের পরিমান। যদিও আমাদের দেশে বেসরকারী বিনিয়োগ আকাংঙ্খিত আকারে বাড়ছে না। আমাদের দেশের নতুন বিনিয়োগ অনেকাংশে নির্ভর করে ব্যাংক ঋণের ওপর। সহজে ও স্বল্পসুদে ঋণ পেলে উদ্যোক্তরা বিনিয়োগে আগ্রহী হন। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ বড় বাধা বলে অভিযোগ  উদ্যোক্তাদের। সম্প্রতি বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এর নেতারা ঋণ ও আমানতের সুদহার কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বেসরকারি ব্যাংক, ঋণের বিপরীতে সুদ ৯ শতাংশের বেশি নিবে না। অন্যদিকে তিনমাস মেয়াদী আমানতের সুদ ৬ শতাংশের বেশি দিবে না। বর্তমানে বিভিন্ন মেয়াদী ঋণের সুদহার সাড়ে ৮ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ এবং তিন মাস মেয়াদী আমানতের সুদহার সাড়ে ৩ থেকে সাড়ে ১০ শতাংশ পর্যন্ত। কিছুদিন আগে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো উচ্চসুদে আমানত সংগ্রহ করেছে। সম্প্রতি ব্যাংকগুলোকে নানা সুবিধা দিয়েছে সরকার। বাজেটে এ খাতকে আড়াই শতাংশ করপোরেট কর হ্রাস করা হয়েছে। গত এপ্রিলে মুদ্রানীতিকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে নগদ অর্থের সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে অর্থের যোগান দিতে ব্যাংক মালিকরা সরকারের কাছ থেকে বেশ কিছু সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন। তারল্য সংকট মেটাতে ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমানো এবং তা সমন্বয় করতে আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত সময় প্রদান। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখা বাধ্যতামূলক জমার হার (সিআরআর) ১ শতাংশ কমানো হয়েছে। যার ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলো হাতে বাড়তি দশ হাজার কোটি টাকা এসেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রাখা সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা। নগদ অর্থের সংকট কাটাতে যদি এত সব পদক্ষেপ নেয়া হয়, তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে আমানত ও ঋণের সুদহার কমানোর সম্ভব কিনা? সুদহার কমালে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখবে না। অন্যদিকে কম সূদের কারণে ঋণের চাহিদা বাড়বে। স্বাভাবিকভাবে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট আরো তীব্র হবে। তবে কি এপ্রিলে নেয়া পদক্ষেপের ফলে দুই মাসেই ব্যাংকগুলোর অর্থের সংকট কেটে গেছে? যদি কেটে যায়,তাহলে এপ্রিলে দেয়া সুবিধাগুলো ফেরত নেয়া যেতে পারে। আর যদি সংকট বিদ্যমান থাকে তাহলে সুদ কমানোর সিদ্ধান্ত কিভাবে বাস্তবায়ন হবে? অনেকের ধারণা, কাগজে কলমে সুদহার ৯ শতাংশ দেখালেও প্রকৃত পক্ষে নানা সার্ভিস চার্জ দেখিয়ে ১২ শতাংশের বেশিই নেয়া হবে। প্রভিশন রাখার ভয়ে গোপন করার চেস্টা করতে পারে খেলাপিঋণের তথ্য। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ২০১৭ সালকে ব্যাংক কেলেঙ্কারির বছর ঘোষণা করেছে। সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে ব্যাংকগুলোকে পরিচালন ব্যয় কমাতে হবে। কমাতে হবে নন পারফারমিং লোনের হার। নতুন বিনিয়োগ শুধুমাত্র উচ্চ সুদহারের জন্য আটকে, তা নয় বরং ব্যাংক ঋণ ছাড়াও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য অনেক ইস্যূ আছে। বাংলাদেশে ব্যবসা শুরুর ব্যয় বেশি। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস সূচকে আমাদের অগ্রগতি নেই। বিশ্বের ১৯০টি দেশের মধ্যে অবস্থান ১৭৭তম এবং ১০০ এর মধ্যে স্কোর ৪০.৯৯। এছাড়া সঞ্চয়-পত্রের উচ্চ সূদের হার আমাদের দেশে গড় সূদের হার না কমার পেছেনে বড় বাঁধা হিসেবে কাজ করছে। আমাদের উৎপাদিত পণ্য সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে কিনা সেই নিশ্চয়তা নেই। আমদানি-রপ্তানিতে বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়ছে না। বাড়ছে ট্রাক আর কনটেইনার জট। পণ্য খালাসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় লাগে। গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া, জমির রেজিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে উদ্যোক্তাদের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘুষ দিতে হয়। নেই সুশাসন। কোন আইনি জটিলতা তৈরি হলে ভূগতে হয় বছরের পর বছর। বাংলাদেশে ঋণের সুদহার বেশির পেছনে মূলত দায়ী ঋণ-খেলাপি, অবলোপন করা ঋণ ও মুদ্রাস্ফীতি। এসব ঋণের কারণেই ব্যাংকের খরচ বেড়ে যায় এবং নিজেদের লাভের অংশ ধরে রাখতে ঋণের সুদহার বাড়িয়ে থাকে। আমানাত গ্রহণ ও ঋণ প্রদানের সূদের হার তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশের থেকে বেশি। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। এর বাইরেও আরো ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ আছে যা অবলোপনকৃত। মোট খেলাপি ঋণের ৪২ শতাংশ বা ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা বেসরকারি ব্যাংকের। খেলাপি ঋণ সুদহার বাড়িয়ে দেয়, ফলে খেলাপি-ঋণ কমিয়ে আনার শক্ত ঘোষণা জরুরি। আর মুদ্রাস্ফীতি বেশি হলে সূদের হারও বেড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতিটি নিয়ন্ত্রণে থাকা জরুরি। ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পলিসি সাপোর্ট প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নজর দেয়া প্রয়োজন বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহের হারে। বেসরকারি খাতে যে ঋণটা যাচ্ছে সেটার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা দরকার। ঋণের টাকা অর্থ পাচারের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, নাকি জমি কেনায় ব্যবহার হচ্ছে? নাকি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। তা খতিয়ে দেখতে হবে। ঋণের টাকা নিজেরা, বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনসহ অযোগ্য লোকদের আরো বেশি করে ঋণ দেয়ার কাজে ব্যবহার হচ্ছে কিনা? সেখানে নজরদারি বাড়াতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের তুলনায় আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোয় তৈরি হয়েছে তীব্র ডলার সংকট। ফলে এক বছরের ব্যবধানে আমদানি পর্যায়ে ডলারপ্রতি ব্যয় প্রায় ৫ শতাংশ বেড়েছে। রফতানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির হার আমদানির তুলনায় অনেক কম কিন্তু বাড়ছে আমদানির পরিমান। বিদেশী ঋণ পরিশোধের পরিমাণও বেড়েছে। এতে করে সরবরাহের তুলনায় বেশি চাহিদা তৈরি হয়ে ডলারের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের পণ্য ও সেবা খাতে প্রচুর পরিমাণ আমদানি ঋণের দায় পরিশোধ হচ্ছে। তাই সামগ্রিকভাবে এক ধরনের টান সৃষ্টি হয়েছে ডলারের বাজারে। আগে আমদানির পরিমাণ কম এবং রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশি হওয়ায় ব্যাংকগুলোয় বাড়তি ডলার থাকত। ওইগুলো তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে বিক্রি করে দিত ব্যাংকগুলো। ফলে বাড়ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। বর্তমানে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাবদ যা আসছে, তা দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো যাচ্ছে না। এলসি খোলার ক্ষেত্রেও কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করা প্রয়োজন। কে কোনো পণ্য আমদানি করছেন। এলসি খোলার সঙ্গে আমদানি পণ্যের সামঞ্জস্য আছে কিনা এসব বিষয়ে অধিক যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। আমদানি-রপ্তানিতে পণ্য ও সেবায় ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং, আমদানি-রপ্তানিতে বহুমাত্রিক ইনভয়েসিং; পণ্য ও সেবা সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা, একইভাবে শিপমেন্টের ক্ষেত্রেও ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। এখানে নজরদারি বাড়াতে হবে। সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হিসেবেই বাজারে মুদ্রার সরবারাহ বাড়াতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তবে মুদ্রাস্ফীতি বিষয়টিও সুসমন্বয় করতে হবে। সিআরআর কমানোটা মনিটরিং পলিসির বিষয়। ব্যাংকগুলো যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। সিআরআর কমালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে এখন ব্যাংকগুলোর খরচ কমবে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। রেপোকে বলা হয় ব্যাংকিং খাতের নীতি উপাদান (পলিসি টুলস)। এর সুদ হারকে বলা হয় নীতি সুদ হার (পলিসি রেট)। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্য ও বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করে। আর রিভার্স রেপোর সুদ হার কমালে বুঝতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইছে ব্যাংকগুলো টাকা ফেলে রেখে মুনাফা না তুলে ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়াক। (বর্তমানে রেপোর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করলে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ সাত দিন রাখতে পারে।) কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিআরআরকে ব্যবহার করে ব্যাংকের আমানতকারীদের রক্ষাকবচ হিসেবে। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পলিসি টুলস ব্যবহার করে। সিআরআর ও রেপো হার কমিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থ পাওয়া আরও সহজ করেছে। ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার বিষয়ে বিএবি যে ঘোষণা দিয়েছে তা শিল্প ও বাণিজ্য খাতের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক খবর। সুদহার এক অঙ্কে নেমে এলে যেসব উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, তারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন। কারণ ব্যবসার খরচ কমে প্রতিষ্ঠানের লাভ বাড়বে। বাড়বে প্রতিযোগিতা ও সক্ষমতা। এতে নতুন বিনিয়োগ হবে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পিছনে ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, ব্যাংকগুলোতে সুশাসনের তীব্র ঘাটতি, আইনের সঠিক প্রয়োগের অভাব, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি, কিছু অসাধু ব্যাংক পরিচালকও দায়ী। তাদের লুটপাট বন্ধে খুব একটা কঠোর কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বরং তাদেরকে আরও বেশি সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। সুদের হার কমাতে হলে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

আরও পড়ুন:

বিষয়: