ঢাকা রবিবার
০৫ মে ২০২৪
২৭ এপ্রিল ২০২৪

পোশাক শিল্পের পরে সিরামিকের অফুরন্ত সুযোগ


নিউজ ডেস্ক
118

প্রকাশিত: ১৫ জানুয়ারীফেব্রুয়ারি ২০১৯
পোশাক শিল্পের পরে সিরামিকের অফুরন্ত সুযোগ



ডেস্ক রিপোর্ট : মৃৎকর্ম বা মৃৎশিল্প সম্ভবত মানব সভ্যতার সবচেয়ে পুরোনো শিল্প। প্রথমদিকে মাটি দিয়ে হাতেই তৈরি হতো দৈনন্দিন ব্যবহার্যের এসব তৈজসপত্র। সময়ের বিবর্তনে সেই শিল্প এখন সিরামিকে রূপ নিয়েছে। এখন আধুনিক যন্ত্রে তৈরি হচ্ছে রঙিন কারুকার্যময় পণ্য। নির্মাণ, গৃহস্থালি এবং শোভাবর্ধক কাজে এসব সামগ্রীর ব্যবহার বহুগুণ বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশেও এ শিল্পের বেশ প্রসার ঘটেছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে বিভিন্ন দেশের বাজারে রপ্তানিও বেড়েছে। সম্ভাবনাময় এ খাত উদ্যোক্তাদের মাঝে আশার আলো জাগিয়েছে। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার ও নানান সমস্যার মধ্যেও গত ১০ বছরে বিনিয়োগ বেড়েছে বহুগুণ। পোশাকের পরে সম্ভাবনার অফুরন্ত সুযোগ তৈরি করতে পারে এ শিল্প। দেশীয় শিল্পের মধ্যে নতুন করে জেগে উঠেছে সিরামিক। বাংলাদেশে সিরামিক শিল্পের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। বগুড়ায় তাজমা সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ ছিল প্রথম কারখানা। সময়ের হিসেবে নিজেদের কারখানা অনেক আগে হলেও ১৯৯০ সাল পর্যন্ত আমদানিনির্ভরই ছিল এ খাত। এরপর থেকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে নীরবেই যেন বিপ্লব ঘটে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গত এক দশকে এ শিল্পের বিপুল উন্নয়ন হয়েছে। দেশে দ্রুত বর্ধনশীল খাতের মধ্যে অন্যতম এখন সিরামিক। বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশীয় সিরামিকের ছয় হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে যা ছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার। অন্যদিকে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এ খাত আগামী পাঁচ বছরে দেশে তৃতীয় বৃহত্তম খাতে রূপান্তর হবে বলে জানান সংশ্নিষ্টরা। আমদানিবিকল্প সিরামিক পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন উদ্যোক্তারা। গত অর্থবছরে ৫৮৫ কোটি টাকার সিরামিক পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ গেছে ভারত, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। সিরামিকের বাজার বর্তমানে দেশীয় ৬৬ ব্র্যান্ডের সিরমিক পণ্য বাজারে পাওয়া যায়। ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে শতাধিক কোম্পানি সিরামিক পণ্য তৈরি করছে। এ খাতের সঙ্গে জড়িত প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ। তবে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও মোকাবিলা করতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের। আকিজ সিরামিকের পরিচালক খোরশেদ আলম সমকালকে বলেন, এ খাতের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। অথচ এখনও শুল্ক্ক দিতে হচ্ছে ৩০ শতাংশ। এটি প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানির বাজারে দেশি শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। কারণ চীন ও ভারতের উদ্যোক্তারা নিজ দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, দেশে তৈরি টাইলস স্থানীয় বাজারে বেশি বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ভারত, নেপালসহ কিছু দেশে রপ্তানি হয়। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ পেলে এবং উৎপাদন ব্যয় কমাতে পারলে পোশাকের পরে রপ্তানিতে বড় খাত হবে সিরামিক। ইউএসএআইডির তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে দেশের সিরমিক খাতে দ্বিগুণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। দেশে এখন সর্বোচ্চ উদীয়মান খাত এটি। সবচেয়ে বেশি প্রসার হয়েছে টাইলসের বাজার। এর আকার সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মতো। অন্যদিকে গৃহস্থালি ৫০০ কোটি এবং স্যানিটারি সামগ্রীর বাজার ৯২০ কোটি টাকার। গত এক দশকে এ খাতে মোটামুটি বিপ্লব ঘটে যায়। উন্নতমানের সিরামিক পণ্য উৎপাদন করে সুনাম কুড়িয়ে ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে মুন্নু, শাইনপুকুর, ফার, বেঙ্গল ফাইন সিরামিকসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি। এসব ব্র্যান্ডের বেশিরভাগই নজর কেড়েছে গৃহস্থালি সামগ্রীর বাজারে। টাইলসের বাজারে এখন আধিপত্য বেশি এক্স সিরামিক গ্রুপের তিন ব্র্যান্ডের। এর পরের অবস্থানে রয়েছে আকিজ। এ ছাড়া মীর, আরএকে ও চায়না-বাংলা, ডিবিএল, প্যারাগনসহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড ভালো করছে। অন্যদিকে স্যানিটারি ওয়্যারের বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে আবুল খায়ের গ্রুপের স্টেলা ব্র্যান্ড। বড় বিনিয়োগে উদ্যোক্তারা দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ আকিজ, আবুল খায়ের, ডিবিএল, শেলটেকসহ আরও অনেক কোম্পানি সাম্প্রতিক সময়ে সিরামিকে বিনিয়োগে এসেছে। নতুন করে জেবি, তুষার, বিএইচএল, মেঘনা গ্রুপসহ ১০ থেকে ১২টি কোম্পানি বিনিয়োগ করছে। শুধু দেশি নয়, বিদেশি বিনিয়োগও এসেছে সিবিসি, নিউ জং ইয়ান, ফু-ওয়াং, আরএকে ও চায়না-বাংলাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের। সব মিলিয়ে গত ১০ বছরে এ খাতে ৮ হাজার ৬২১ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। নতুন বিনিয়োগে প্রায় ৪০ কারাখানা স্থাপন করেছেন উদ্যোক্তারা। আরও ১৫ কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। এতে আরও প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। এগুলো আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসবে। নতুন করে আরও এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে। সিরামিক অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, আধুনিক স্থাপনাগুলোতে টাইলসের ব্যবহার বেড়েছে। এতে গত পাঁচ বছরে চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে। প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অন্যান্য পণ্যের চাহিদা বেড়েছে ২০ থেকে ২২ শতাংশ হারে। বিদ্যমান কারখানাগুলো স্থানীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। গত ১০ বছরে দু-একটি কারখানা সব ধরনের সিরামিক পণ্য উৎপাদনে এলেও টাইলস উৎপাদনে এসেছে নতুন ১০ কোম্পানি। আরও ১২ থেকে ১৫ ব্র্যান্ডের পণ্য বাজারে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। পাশাপাশি কারখানা সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে অনেক কোম্পানি। চলতি বছরে উৎপাদনে এসেছে শেলটেক সিরামিক। দ্বীপজেলা ভোলায় প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে কারখানা স্থাপন করেছে আবাসন খাতের কোম্পানিটি। দৈনিক চার লাখ টন উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে এ কারখানার। কোম্পানির দাবি, এশিয়ার মধ্যে সর্ববৃহৎ সিরামিক কারখানা এটি। শেলটেক গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুব উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, সম্ভাবনার কথা ভেবেই তারা এ খাতে বিনিয়োগে এসেছেন। শেলটেক ক্রেতাদের আস্থা ধরে রেখে পণ্য ও সেবা দিয়ে আসছে। সিরামিকেও তারা আস্থা অর্জন করবেন। আগামী বছরের মাঝামাঝিতে পুরোপুরি উৎপাদনে যাবে তাদের কারখানা বলে উল্লেখ করেন তিনি। ২০১৬ সালে উৎপাদনে এসেছে ডিবিএল। একই বছর তুষার সিরামিক টাইলসের কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগে এসেছে বাংলাদেশ হার্ডল্যান্ড সিরামিক (বিএইচএল)। কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক সাদেকুর রহমান সমকালকে বলেন, হবিগঞ্জে দৈনিক এক লাখ বর্গফুট টাইলস উৎপাদন সক্ষমতার কারখানায় এখন যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ চলছে। আগামী জানুয়ারি থেকে পরীক্ষামূলক উৎপাদনে যেতে চান তারা। তিনি বলেন, সিরামিক খাতে স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানিতে অনেক সম্ভাবনা বাড়ছে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় টিকে থাকতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক্ক ছাড় দেওয়ার দাবি জানান তিনি। আকিজ সিরামিক এখন টাইলস ও স্যানিটারি ওয়্যার উৎপাদন করছে। আগামী বছরে গৃহস্থালি সামগ্রী বাজারে আনতে ৫০০ কোটি টাকা নতুন বিনিয়োগ করেছে। তারা এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। অন্যদিকে আবুল খায়ের গ্রুপ ২০১০ সালে কিনে নেয় ফাহিম সিরামিকস। পরে নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপন করে স্যানিটারি সামগ্রী উৎপাদন শুরু করে। রপ্তানি সম্ভাবনা সিরামিকের আন্তর্জাতিক বাজার প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের। এর মধ্যে বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের পণ্য যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ ৫০টির বেশি দেশে। এর মধ্যে ২০ শতাংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রে ও ৩০ শতাংশ ইউরোপে। মধ্যপ্রাচ্যের বাজারও নতুন দুয়ার খুলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব খুব সামান্য হলেও যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের প্রভাবে রপ্তানি চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল তিন কোটি ৭ লাখ ডলার বা প্রায় ২৯০ কোটি টাকা। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৫৮৫ কোটি টাকা। গত তিন অর্থবছর ধরে বাড়ছে রপ্তানি। স্থাপন প্রক্রিয়ায় থাকা কারখানাগুলো উৎপাদনে এলে ২০২৫ সালে দ্বিতীয় রপ্তানি খাত হবে সিরামিক বলে আশা সংশ্নিষ্টদের। বর্তমানে সরকার সিরামিক পণ্য রপ্তানিতে ১০ শতাংশ সহায়তা দিচ্ছে। সম্ভাবনার বিচারে এটি আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। উৎপাদনে বিপ্লব নতুন অনেক কারখানা চালু হওয়ায় দিন দিন উৎপাদন বাড়ছে সিরামিকের। নতুন টাইলসের কারখানাগুলো গড়ে এক লাখ বর্গফুটের বেশি উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে স্থাপন করা হচ্ছে। বিদ্যমান চালু কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতেও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি। বাংলাদেশ সিরামিক ওয়্যারস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন ৬৬টি প্রতিষ্ঠান সিরামিক উৎপাদন করছে। এর মধ্যে টেবিলওয়্যার উৎপাদনকারী ২০ কোম্পানি বছরে ২৫ কোটি পিস সিরামিক পণ্য তৈরি করছে। টাইলসের ৩০ কারখানা থেকে ১৫ কোটি বর্গমিটার উৎপাদন হচ্ছে। ১৬ স্যানিটারি ওয়্যার কোম্পানি বছরে ৫৫ লাখ পিস স্যানিটারি সামগ্রী তৈরি করছে। আগামী বছরে আকিজ সিরামিক তাদের নতুন ইউনিট থেকে ২৫০ লাখ পিস থালা-বাসন উৎপাদন করবে। স্যানিটারি ওয়্যারের বড় অংশ দখল করে আছে আবুল খায়ের গ্রুপের স্টেলা ব্র্যান্ড। এ কোম্পানি বছরে ২০ লাখ পিস পণ্য তৈরি করছে। আরএকে ১৫ লাখ পিস এবং গ্রেট ওয়াল ১০ লাখ পিস স্যানিটারি ওয়্যার উৎপাদন করছে। বিদ্যমান বাজারের বড় অংশীদার গ্রেট ওয়াল টাইলসও। তারা বছরে দেড় কোটি বর্গফুট টাইলস উৎপাদন করছে। সূত্র: সমকাল অনলাইন

আরও পড়ুন:

বিষয়: