গত তিন দশকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। বৈশ্বিক জিডিপির ৪০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে এই অঞ্চল। কিন্তু কোভিড-১৯ এসে সব হিসাব যেন এলোমেলো করে দিয়েছে। কোভিডের আগে বাণিজ্য সুরক্ষানীতি ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণেও এই অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছিল। তাতে কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন করে ভারসাম্য আনতে হয়েছে। জনগোষ্ঠীর বয়স বেড়ে যাওয়া নতুন আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে তরুণ জনগোষ্ঠীকে নতুন দক্ষতা রপ্ত করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কী করতে হবে, তা নিয়ে সমীক্ষা করেছে প্রাইস ওয়াটারহাউস কুপার্স। তারা বলছে, এই পরিস্থিতিতে সম্মিলিত কর্মতৎপরতা প্রয়োজন। প্রতিবেদনে প্রবৃদ্ধির পাঁচটি স্তম্ভ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলোকে সমাধানসূত্র হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, আগামী দিনের অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় এই স্তম্ভগুলো সুরক্ষা হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে মানুষ ও সমাজই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে কাজ করবে, সে কথাও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, সমাজের মানুষের চেতনাই শেষমেশ সবকিছুর গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে। স্তম্ভগুলো নিম্নরূপ:
১. ডিজিটাল অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, অর্থনীতির নতুন গতি-প্রকৃতি ও ভোক্তাদের পরিবর্তনশীল চাহিদার কথা বিবেচনা করে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত ডিজিটাল প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে হবে। সে জন্য প্রথমেই নির্ধারণ করতে হবে, ঠিক কোথায় এই ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। এরপর যথাসময়ে ও স্থানে প্রযুক্তিগত সমাধান নিয়ে আসতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের কারণে মানুষের তথ্য-উপাত্তও হুমকিতে পড়তে পারে। তথ্যের সুরক্ষা সারা পৃথিবীতেই মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে।
২. আঞ্চলিক উদ্যোগের প্রবৃদ্ধি
আঞ্চলিক সংযোগ বাড়াতে হবে। সারা পৃথিবীতে যেভাবে অনিশ্চয়তা বাড়ছে, তাতে প্রবৃদ্ধির সম্ভাব্য খাত চিহ্নিত করতে উদ্যোক্তাদের পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে হবে। সক্ষমতাভিত্তিক আঞ্চলিক সংযোগের কৌশল প্রণয়ন করতে হবে, যার ভিত্তি হবে তিনটি মৌলিক ক্ষেত্র—১. পরিচালনগত দক্ষতা, ২. পণ্য ও প্রক্রিয়ার অভিনবত্ব ও ৩. বাজারের উৎকৃষ্টতা। ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ, অংশীদারি বৃদ্ধি, স্থানীয় প্রতিভার বিকাশ, সংস্কৃতি—এসবও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হিসেবে কাজ করবে। কোভিডের কারণে ডিজিটালাইজেশনের গতি বেড়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, তথ্য—এসব খাতে ডিজিটাল ব্যবসার নতুন দিকের উন্মোচন হয়েছে।
৩. সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন ভারসাম্য ও উদ্ভাবনে জোরারোপ
বিশ্বায়ন বিরোধিতা আগে থেকেই তুঙ্গে, কোভিডের কারণে তা আরও গতি পাবে বলেই ধারণা করা যায়। এর ফলে আঞ্চলিক সংযোগের গুরুত্ব বাড়ছে। কোভিডের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সরবরাহ ব্যবস্থা। এই পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলোকে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলায় নজর দিতে হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন এই সরবরাহ ব্যবস্থা কোম্পানিগুলোকে ক্রয়, উৎপাদন ও বিতরণে বিশেষ সুবিধা দেবে। এতে যেমন এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে, তেমনি সরবরাহ ব্যবস্থাও স্থিতিস্থাপক হবে।
৪. শ্রমিকদের সুরক্ষা
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে দক্ষ ও প্রাসঙ্গিক শ্রমশক্তি প্রয়োজন। শ্রমিকদের নতুন করে প্রশিক্ষিত করে তোলার মধ্য দিয়ে এটি অর্জন করা সম্ভব। বাজারের প্রয়োজনীয়তার সাপেক্ষে এর রূপ নির্ধারণ করতে হবে, সঙ্গে দরকার সরকার ও বেসরকারি খাতের গভীর সমন্বয়। শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে সরকারকে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রথমত, তাকে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে হবে; দ্বিতীয়ত, সবাইকে নতুন যে ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করতে হবে, সেই রূপরেখাও তাকে দিতে হবে।
৫. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সবচেয়ে বিপদে আছে। ফলে টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে এই ইস্যুটি জনপ্রিয় করতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার, ব্যবসায়ী ও সমাজের মধ্যে সহযোগিতা আরও গভীর করতে হবে। এ ছাড়া খাদ্যনিরাপত্তাও এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য হুমকি। তাই কৃষি উৎপাদন বাড়াতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর বিকল্প নেই।
এই পাঁচটি স্তম্ভ এককভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়—পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হলে কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। সে জন্য পরিবর্তন আনতে হলে পাঁচটি স্তম্ভকে একসূত্রে নিয়ে আসতে হবে।