স্টাফ রিপোর্টার: দেশের ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতির সঙ্গে দেশের পুঁজিবাজারের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সামগ্রিক অর্থনীতি চাঙ্গা থাকলে পুঁজিবাজারও চাঙ্গা থাকার কথা। আর অর্থনীতি মন্দা হলে পুঁজিবাজারও মন্দার চলবে এটাই হওয়া উচিৎ। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির প্রভাব কম। আবার আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ইতিবাচক হওয়ার সত্ত্বেও দীর্ঘদিন পুঁজিবাজারে তার ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায় না বরং উল্টাটা হয়।
কারণ আমাদের অর্থনীতিতে সবথেকে বেশি অবদান রাখে যে সব সেক্টর ও কোম্পানিসমূহ তাদের সিংহ ভাগ পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত না। আর আমাদের অর্থনীতির বৈশ্বিক অর্ন্তভূক্তি যথেষ্ট পরিমান কম। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি খারাপ হলে বিশেষ করে বাংলাদেশ যে সব দেশে রপ্তানি করে, তাহলে রপ্তানিমূখি সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৫৬ প্রতিষ্ঠানের হাতে জাতীয় রপ্তানি ট্রফি দিয়েছে সরকার সেখানে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানির সংখ্যা মাত্র সাতটি। বাকী ৪৯টি কোম্পানিই পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত নেই। বিস্তারিত দেখুন লিংকটিতে ক্লিক করে। রফতানি অায়ে পদক পাচ্ছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৭ প্রতিষ্ঠান।
অামাদের দেশের জিডিপিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানির অবদান হতাশাজনক। এর মূল কারণ ভাল কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত হতে অনিহা, যদিও পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানির জন্য ট্যাক্স ছাড় আছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত হতে ধীরগতি, আইনি কিছু জটিলতা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার ভয়, সরকারের কঠোর না হওয়া। যেমন অভিযোগ আছে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত না হয়েও নানা কেীশালে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কোম্পানি গুলো। ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত কোম্পানির জন্য ট্যাক্স ছাড় তাদের প্রয়োজন হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা, মার্চেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঠিক নির্দেশনা ও কার্যক্রমের অভাবে বাজার এখনও শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি। বাজারের ভেতরের কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে মানুষের আস্থার জায়গায় এখনো পুঁজিবাজার পৌঁছাতে পারেনি । সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইনসাইডার ট্রেডিং, অসৎ উদ্যোগতাদের দমন করে পুরোপুরি বাজারকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনতে পারেনি।
দেশি বিদেশি অনেক ভাল কোম্পানিও গ্রুপকে পুঁজিবাজারে তালিকাভূক্ত করা যাচ্ছেনা। ইউনিলিব্রাদার, আবুল খায়েরগ্রুপ, আকিজগ্রুপসহ বহু কোম্পানি গ্রুপ ভাল ব্যবসা করছে কিন্তু তারা পুঁজিবাজারে নেই। মজার ব্যাপার হলো আকিজগ্রুপ পুঁজিবাজারে না থাকলেও ব্যবসা তারা ভাল বোঝে, পুঁজিবাজারে ব্র্রোকারেজ হাউজ খুলে ঠিকই ব্যবসা করছে।
বাজারে এখনও অনেক কোম্পানির শেয়ার অবমূল্যায়িত। অনেক কোম্পানির শেয়ারদর এখনও তলানিতে। এছাড়া মিউচুয়াল ফান্ডের অনেকগুলোই ন্যাভভ্যালুর ৩০ বা ৪০ শতাংশ নিচে অবস্থান করছে। এসব ফান্ডের ডিভিডেন্ট ঈল্ড ভাল। এসব শেয়ার এবং ফান্ডে বিনিয়োগ তুলনামূলক কমঝুঁকিপূর্ণ হলেও কম মুনাফা হবে অশঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হচ্ছে না। ফলে শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড অবমূল্যায়িতই থেকে যাচ্ছে।
কিনতু সচেতন কবনিয়োগকারী একটু খেয়াল করলে দেখবেন অধিকাংশ ক্যাশ লভ্যাংশ প্রদান করা ভাল ডিভিডেন্ট ঈল্ড সম্পন্ন মিউচুয়াল ফান্ডের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী। বিনিয়োগকারীরা একটু সচেতন হলেই এসব শেয়ারের চাহিদা আগামীতে বাড়তে পারে।
আবার সচেতনতা শুধু ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বাড়াতে হবে বিষয়টি শুধুমাত্র এমন নয়। বরং সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থা,মার্চেন্ট ব্যাংকসহ বাজার সংশ্লিষ্ট সবাইকে সচেতন হতে হবে। বন্ধ করতে হবে ইনসাইডার ট্রেডিং।
ব্যাংকগুলো নিজস্ব পোর্টফোলিও, মার্চেন্ট ব্যাংক পরিচালনা বা ব্রোজারেজ হাউজ পরিচালনা, শেয়ারের বিপরিতে ঋণ প্রদান, অন্যের পোর্টফোলিও ম্যানেজসহ বিভিন্নভাবে পুঁজিবাজারের সাথে জড়িত। অতএব তাদেরকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। দাম বাড়লেই বাজার ভালো এই ভাবনাটা সঠিক নয়।কোম্পানির মেীলভিত্তির উপর দর না বাড়লে সেটা স্থায়ী হয় না। বাজারে টাকার সমস্যা মূখ্য নয়, নীতিগত এবং আস্থার সঙ্কটই বড়। আস্থার সঙ্কট কেটে গেলে বাজারে তারল্য চলে অাসে।
২০১০ সালে যখন বাজারের জন্য খারাপ সময় যাচ্ছিল তখন মিউচ্যুয়াল ফান্ডের অনুমোদন দেওয়ার ফলে র্স্মাট মানি, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের হতে অভারভ্যালূড দরে শেয়ার ধরিয়ে বাজার থেকে চলে যায়নিতো? ফলে ব্যাক্তি বিনিয়োগকারীর মতই মিউচ্যুয়াল ফান্ডও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
বর্তমানে টাকা এক মাত্র সমস্যা নয়। সমস্যা হলো টাকা বিনিয়োগের মত শেয়ার কতটা অাছে। ভালো শেয়ার, ভাল ম্যানেজমেন্ট হাতে গোনা কয়েকটি। তারল্য যেমন প্রয়োজন তেমনি ভালো ইস্যু দরকার। বাজার যখনই স্থিতিশীলতার দিকে যায় তখনই বড় বড় প্রতিষ্ঠান, অনেক উদ্যোতার সেল প্রেসারে বাজার আবার পড়ে যায়। বাজারের গভিরতা বাড়াতে হবে। বাজারে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে হবে।
আমাদের অর্থনীতি ভাল চলছে। রেমিট্যান্স প্রবাহে পড়তি ধারার পর বাড়তে শুরু করেছে। বিদায়ী বছরে অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক ছিল ভাল। যদিও বেসরকারী বিনিয়োগে স্থবিরতা রয়েছে কিন্তু সরকারী বিনিয়োগে সরকার সেটা পূরণের চেস্টা করেছে এবং সম্প্রতি সূদের হার কমাতে উদ্যোগ নিয়েছে। বির্তক আছে সঞ্চয়পত্রের সূদের হার নিয়ে। সরকার এখানে সামাজিক নিরাপত্তা কথা তুলে ভোট ব্যাংক রক্ষা করছে বলে অভিযোগ অাছে। ব্যাংক খাতে নন- পারফারমিং লোন নিয়ে হতাশা আছে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বছর শেষে মূল্যস্ফীতি সহনীয় নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন স্বস্তি দিয়েছে। দূরদর্শী নীতির কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। তবে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আর্থিক খাতের সুশাসন ও স্বচ্ছতার অভাব এখন আছে। বাংলাদেশে ভাল কর্পোরেট কালচারের অভাব খুবই তীব্র।
এ ছাড়া বৈষম্য বৃদ্ধি, সীমিত উৎপাদন সক্ষমতা, দেশ থেকে টাকা পাচার এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিকাঠামোর অদক্ষতা অর্থনীতিতে মধ্যমেয়াদি কিছু চ্যালেঞ্জ অাছে। এ অবস্থার উত্তরণে আর্থিক খাতে প্রতিষ্ঠানিক সংস্কার, ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতির মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন।
দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। গত এক দশকের বেশি ধরে এ প্রবৃদ্ধি বজায় অাছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের হার বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
অর্থনীতির অন্যতম একটি উদ্বেগের বিষয় হল কর্মসংস্থান না বাড়া বা যুবক শ্রেণির অনুপাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া। যদিও আইটি সেক্টরসহ অন্যান্য সেক্টরের মাধ্যমে সরকার বিশ্বব্যাপি বাংলাদেশি যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি সুযোগ তৈরিতে সহযোগিতা দিচ্ছেন। তবুও এটা আরো বৃদ্ধি প্রয়োজন। সুবিধাবঞ্চিতদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন প্রয়োজন।
অন্যদিকে দেশ থেকে অর্থ পাচার বাড়ছে। প্রবৃদ্ধির টাকা পাচার হলে দেশের থাকবে কী। এখানে সরকারকে কঠোর হতে হবে। অর্থনীতির অন্যতম একটি সূচক হল রাজস্ব আয়। রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনা ভালভাবে কাজে লাগানো প্রয়োজন। বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন আমদানি হ্রাস ও রপ্তানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বাড়ছে।