স্টাফ রিপোর্টার : তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদনের নানা অসঙ্গতির বিষয়ে নিরীক্ষক আহমেদ অ্যান্ড আখতার চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসের কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)।
মঙ্গলবার, ১৪ মে বাণিজ্যিক নিরীক্ষার এই ওয়াচডগ সংস্থা নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাখ্যা তলব করে চিঠি পাঠিয়েছে। এফআরসি সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদনের নিরীক্ষা সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে আহমেদ অ্যান্ড আখতার চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টসকে ৭ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে এফআরসি বাংলাদেশ অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ডের প্রেক্ষিতে কপারটেকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, বাংলাদেশ (আইসিএবি) এর মূল্যায়ন ও মতামত চেয়েছে।প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি করে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনকারী কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে হিসাবকারসাজির অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন নানা অসঙ্গতি আর অবিশ্বাস্য তথ্যে ভরা। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে সংশ্লিষ্টদের অভিমত, এটি (কপারটেক) একটি দূর্বল মৌলভিত্তির কোম্পানি। আইপিও’র অনুমোদন ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার হীন উদ্দেশ্যে কোম্পানিটি হিসাব ও আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি করেছে।
কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদন নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠায় গত বৃহস্পতিবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালনা পর্ষদ তার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি গভীরভাবে খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন অসঙ্গতি চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য স্টক এক্সচঞ্জেরে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে ৭ দিন সময় দেওয়া হয়। তাদের প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরিচালনা পরিষদ পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। এর আগে কোম্পানিটিকে তালিকাভুক্ত করা হবে না।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) এক চিঠির মাধ্যমে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদনের নানা অসঙ্গতি, কারসাজি ও অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ করলে তার প্রেক্ষিতে ডিএসইর পর্ষদ ওই সিদ্ধান্ত নেয়।
জানা গেছে, ডিবিএ’র অভিযোগ, ডিএসইর সিদ্ধান্ত ও বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টের প্রেক্ষিতে এফআরসিও বিষয়টি খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রেক্ষিতেই কপারটেকের নিরীক্ষকের কাছে ব্যিখ্যা তলব করা হয়েছে।
তামার তার,বার,পাইপ ও তামাজাত বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি কপারেটেক ইন্ডাস্ট্রিজ আইপিওর মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে ২০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। আইপিও’র প্রসপেক্টাসে দেওয়া তথ্য অনুসারে, আইপিওর মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থের একটা অংশ কোম্পানিটি ভবন ও অন্যান্য পূর্তকাজের পাশাপাশি প্লান্টের যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপনের কাজে ব্যয় করবে। একটি অংশ ব্যয় করবে ব্যাংকঋণ পরিশোধ ও আইপিও প্রক্রিয়ার ব্যয় নির্বাহে।
২০১২ সালে মাত্র আড়াই কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করা কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ ভেল্কী দেখিয়ে মাত্র ৫ বছরের মধ্যে মূলধন ৪০ কোটি টাকা বা ১৬ গুণে উন্নীত করে। আইপিওতে আসার আগের দুই বছরে। ২০১৭ সালে কোম্পানিটি ৩ দফায় মূলধন বাড়িয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। তাতে পরিশোধিত মূলধন বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে কোম্পানিটি প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে, যা সে সময়ে বিদ্যমান মূলধনের ২ গুণ। আইপিওকে সামনে রেখেই প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের জন্য এটি করা হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএসই ও ডিবিএ’র ভাষ্য অনুসারে, কপারটেকের আর্থিক বিবরণীতে এমন নানা তথ্য-পরিসংখ্যান রয়েছে,যা অবিশ্বাস্য ও পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। প্রসপেক্টাসের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে অসংখ্য অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। প্রসপেক্টাসে দেওয়া তথ্য অনুসারে,২০১৭-১৮ হিসাববছরে কপারটেকে ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালন ব্যয় (কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যয়) ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এ হিসেবে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (MD)২১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির মাসিক বেতন দাঁড়ায় ৭ হাজার টাকা মাত্র। আর এমডিসহ শীর্ষ ৬ জন কর্মকর্তার বেতন বাদ দিলে বাকী কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মাসিক গড় বেতন দাঁড়ায় মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা,যা বর্তমান সময়ে একেবারেই অবিশ্বাস্য।
এদিকে এফআরসি’র এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করে, এফআরসি যদি এভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে আন্তরিক থাকে তাহলে নিরীক্ষা কাজ ও আর্থিক প্রতিবেদনে স্বচ্ছতা অনেক বাড়বে। এতে আর্থিক খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি কমে আসবে। একদিকে পুঁজিবাজারে দূর্বল কোম্পানির প্রবেশ অনেকটা কঠিন হয়ে পড়বে।
অন্যদিকে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পক্ষেও হিসাবকারসাজি করতে বিনিয়োগকারীদেরকে ঠকানো কঠিন হবে। হিসাবকারসাজি কমানো গেলে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে। সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাজার ও দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে।